সংবাদ শিরোনাম ::
আঙুল চেটে খাওয়ার ফলে বরকত লাভের অধিক সম্ভাবনা থাকে। কারণ খাবারের বরকত কোথায় রয়েছে মানুষ তা জানে না। রাসুল (সা.) বিস্তারিত..
রমজান হোক পুণ্যময়
বছর ঘুরে আবারো এলো মাহে রমজান। শুরু হলো মুমিনের সিয়াম সাধন। এ মাসটি তাদের বোনাসের মাস। কৃষক ফসল কাটার মৌসুমে প্রচণ্ড পরিশ্রম করে যেমন আনন্দ পায়; তেমনি আনন্দ অনুভব করেন একজন প্রকৃত মুমিন রমজানে কৃচ্ছ্রতা সাধন করে। দিনের উপবাস রাতের তারাবির নামাজ কষ্টকর হলেও এগুলো তাদের কাছে সুখকর মনে হয়। কারণ এ মাসের ইবাদত অন্য মাসের ইবাদত অপেক্ষা ৭০ গুণ বেশি সওয়াব এনে দেয়। ওমরাহ হয় হজতুল্য। নফল হয় ফরজের সমান। তাই মাসটিকে ইবাদতের বসন্তকালও বলা চলে। খাঁটি বান্দারা বিলীন হন স্রষ্টার প্রেমে। তাদের ধ্যান-সাধনায় যাতে সমস্যা সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য শৃঙ্খলিত করা হয় শয়তানদের। খোলা হয় জান্নাতের দরজা। বন্ধ হয় জাহান্নামের ফটক। আকাশের ফেরেশতারা স্বাগত জানান প্রভুর প্রিয় বান্দাদের। নেককারদের বলা হয়- ‘সামনে বাড়ো’। বদকারদের বলা হয়- ‘এবার থামো’। রহমত, মাগফিরাত আর নাজাতের সারণিতে বিভাজিত হয় পুরো মাস। মহামান্বিত ‘লাইলাতুল কদর’ এনে দেয় ৮৩ বছর চার মাস অপেক্ষা বেশি দিন ইবাদতের সওয়াব! এ মাসে যে পাপী তার গুনাহ মাফ করাতে পারে না সে বড় হতভাগা! রমজানের প্রতি প্রহরের আছে বিশেষ বিশেষ মর্যাদা। আহার-পানীয়তে আছে প্রচুর সওয়াব। বান্দার ইফতারে যেমন দয়াময় আনন্দিত হন; তেমনি এক টুকরো খেজুর কিংবা পানি অপর রোজাদারের মুখে ধরতে পারলেও দেন পূর্ণ রোজার সওয়াব! দানেও মিলে অন্য মাস অপেক্ষা ৭০ গুণ বেশি পুণ্য! আলহামদুলিল্লাহ! এদিকে মুমিনের আবেগ ও সরলতাকে কাজে লাগিয়ে রমজানে মালামাল হওয়ার অপেক্ষায় থাকেন কিছু অবুঝ ব্যবসায়ী ভাই। নিত্যপণ্যের দামে ঘিয়ে আগুন ঢালতে শুরু করেন। কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পথ খোঁজে বেড়ান। তাদের কাছে কী রোজা, কী কোরবানি কোনো ইবাদতেরই মাহাত্ম্যবোধ নেই। কাফনের কাপড়ে দ্বিগুণ লাভ করতেও দ্বিধাগ্রস্ত হন না। ধর্মের বাণী নিবৃতে কাঁদে; তারা আপন নীতিতেই চলেন। জল্লাদ-হারানো হৃদয় ফকিরের জন্যও গলে না। ইতোমধ্যেই দফায় দফায় বাড়িয়ে চলছেন নিত্যপ্রয়োজনীয় কয়েকটি পণ্যের দাম। টার্গেট রমজানে সারা বছরের কামাই করা। প্রশাসন হুমকি-ধমকি দিলেও কাজের কাজ ঠিকই করছেন। অবশ্য তাদের আঁচল তলে মহাশয়রাও (?) লুকিয়ে থাকেন। সরকার বারবার ব্যর্থ হচ্ছে তাদের ঠেকাতে। এ জন্য আমাদেরও কিছু করণীয় আছে। অনেকে টাকার দেমাগে নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। বাজারে গিয়ে লম্বা একটি ফিরিস্তি দোকানিকে দিয়ে ভদ্র সেজে বসে থাকি। পণ্যের দাম জিজ্ঞেস যেন মানা। শেষে ‘ভাউচার’! নামের কী একটা দেয় যেটা পড়তে অনুবাদক দরকার! এক নজর তাকিয়ে কিছুই না বুঝে শুধু টুটাল অ্যামাউন্ট দেখে একগাল হেসে বিল দিয়ে চলে আসি। এটি গরিবকে কাঁদায়। নিম্ন আয়ের লোককে ভোগায়। মধ্য আয়ের মানুষকে সঙ্কটে ফেলে। আমাদের কেনাকাটার ধরন ও পরিমাণেও নজর দেয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে রমজানের কেনাকাটায়। অনেকে ব্যস্ততার অজুহাতে পুরো রমজানের বাজার-সওদা এক সাথে করে নিই। তাও বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আবার অনেকে রমজানকে বেহিসাব খাবারের মাস ধরে ইফতার সাহরিতে খাবার আইটেমের মজমা জমাই। বাহারি খাবারের পসরা সাজাই। সারা বছর যা খাই না বা লাগে না সেগুলোও খাবার টেবিলে থাকতে হবে। আর বেরোজদারদের কথা কী বলব, তাদের ইফতার পার্টি আর সাহরি ভোজের দৃশ্য দেখে অবাক না হয়ে পারবেন না। রমজান যেন তাদের কাছে খাবারের ঝুড়ি খোলে বসে। বলতে পারেন নিজের টাকায় কিনব, নিজের খাবো তবু এত হিসাব আর কথা কেন? প্রশ্নটা আমারও। কিন্তু রোজা তো সংযমের মাস। আত্মনিয়ন্ত্রণের মাস। নিজেকে মলিন করে বিলীন করার মাস। অভাবী, অসহায়, দিনমজুর আর ক্ষুধার্তের দুঃখ-বেদনায় ভাগীদার হওয়ার মাস। আদৌ তা হচ্ছে কি না তা পরীক্ষা করা দরকার। একমাস দিনের খাবারে বিরত থেকে সন্ধ্যার ইফতার আর শেষ রাত্রির সাহরিতে যদি ভোজন বিনোদনে মেতে ওঠি তবে আল্লাহ জানেন আমাদের তাকওয়ার কী অবস্থা। এমন তাকওয়া নাজাতে কেমন ভূমিকা রাখবে। আজকাল বাজারি পণ্যের খুবই নাজুক অবস্থা। মানুষ যেহেতু রমজানে বেশি খায় বেশি কেনে এ জন্য ভেজাল পণ্যে সয়লাব হয় বাজার। এ কাজ নামাজি, রোজাদার ব্যবসায়ী পর্যন্ত করে থাকেন। পণ্যের মন্দ এক ফোঁটাও বলেন না। দামে কিছুটা তারতম্য করলেও ভেজাল বলতে নারাজ। কারণ ব্যবসা হবে না। আসল-নকল না চিনে ভেজাল খেয়ে অসুস্থতায় ভোগেন অনেকে। এতেও রমজানে ইবাদতে খলল সৃষ্টি হয়। যারা খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণ করেন তারা কেমন রোজাদার বুঝে আসে না। এ জন্য ব্যবসায়ী ভাইদের অনুরোধ করব রমজানে ভেজাল পণ্য বিক্রি না করার এবং রোজাদার ভাইদের আবেদন জানাব ভালো খেতে ও কম খেতে। এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। রোজা শুধু পেট নিয়ন্ত্রণের জন্য নয়। দেহের প্রতিটি অঙ্গের সাথে আত্মারও সংযম প্রয়োজন। রোজা রেখে গালমন্দ করা, গিবত করা, কটুকথা বলা, কাউকে মারধর করা, পর নারীর প্রতি কামাসক্ত হয়ে তাকানো, অশ্লীল দৃশ্য অবলোকন- এসব রোজাকে হালকা করে, কখনো নষ্টও করে দেয়। রোজা মুনিনের জন্য জাহান্নাম থেকে আত্মরক্ষার ঢালস্বরূপ। এই ঢাল যত মজবুত হবে আত্মরক্ষার বিষয়টি তত ভালো হবে। এসবের ফলে ঢালটি ছিদ্র হয়ে যায়। আত্মার নানা রকম ব্যাধি আছে। রাগ, ঘৃণা, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, অহঙ্কার ইত্যাদি আত্মার মারাত্মক ব্যাধি, এসব নিয়ন্ত্রণও রোজার গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। আমরা খাবার-দাবার আর স্ত্রী সম্ভোগ থেকে দূরে থাকলেও ঝগড়া-বিবাদ, খুনখারাবি থেকে দূরে থাকতে পারি না; যা রোজার মূল লক্ষ্যের বিপরীত। এমনকি অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, রোজার দিনে মানুষ বেশি ঝগড়া করে। বিশেষ করে মফস্বল কিংবা গ্রাম-পল্লীতে। তাই অনেককে বলতে শোনা যায়- ‘রোজায় তো শয়তানরা আবদ্ধ থাকে তাহলে শয়তানি করায় কে?’ কথা ঠিক। তবে শয়তানের ডেফিনেশন বা পরিচিতিতে একটু ভিন্নতা আছে। শয়তান মূলত তিন প্রকারের হয়ে থাকে। এক. নফস শয়তান, যাকে নফসে আম্মারা বলে। যাবতীয় পশু চরিত্রগুলো সে ধারণ করে। ষড়রিপু বা কুরিপুও তাকে বলা চলে। তাকে দমন করা ব্যক্তির দায়িত্ব। দুই. মানুষ শয়তান বা অসৎ লোকদের সংস্র্রব-সাহচর্য। অসৎ সঙ্গ বা খারাপ মানুষগুলো দ্বিতীয় শয়তানের ভূমিকা পালন করে। তা থেকে বেঁচে থাকাও মানুষের ব্যক্তিগত দায়িত্ব। তিন. ইবলিশ শয়তান। সে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। তাকে দমন করা আল্লাহর দায়িত্ব। সুতরাং শয়তান এবং তার দলবলের যাবতীয় অনিষ্ট থেকে আল্লাহ তাঁর বান্দাকে রমজানে রক্ষা করার জন্য তাদের ঠিকই আবদ্ধ করেন। কিন্তু বাকি দুই প্রকার শয়তানদের দমনের দায়িত্ব বান্দার। তা করে না বিধায় রোজার দিনেও নানা রকম শয়তানি দেখি। তা ছাড়া দীর্ঘ ১১ মাস যারা শয়তান নিয়ে খেলা-মেলা করে, শয়তানের পিছু দৌড়ায়, তাদের মধ্যে তো শয়তানের একটি প্রভাব থেকেই যায়। অতএব, রমজানকে পুণ্যময় করতে ব্যক্তি সাধনার বিকল্প নেই। মুসলিম হিসেবে প্রতিজনকে সজাগ সতর্ক থাকার পাশাপাশি নিজের প্রভাব-বলয়ের ভেতরে ঘটমান প্রত্যেক অন্যায় ও অশ্লীল কাজের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। ঈমান-আমল বিধ্বংসী গান-বাজনা, নারীনৃত্য, বেহায়াপনা সে যেখানেই হোক- সিনামা হল, নাইট ক্লাব কিংবা টিভি সিরিয়ালে অথবা বাজার-পার্কে সর্বত্রই তা রমজানের পবিত্র আবহ রক্ষার্থে বন্ধ করা দরকার। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ পরিচালক সরকার যদি রমজানের পবিত্রতার ৯০ শতাংশ অন্তত রক্ষা করতে পারত, বাকি ১০ ভাগের জন্য সবাই মিলে ভিন্নধর্মীদের সাহায্য চাইলে শতভাগই সম্ভব হতো। কিন্তু জানি ধর্মনিরপেক্ষতার দোহায়ে সব কিছুই হবে সব কিছুই চলবে।