ঢাকা ০৪:২২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

খোশ আমদেদ মাহে রমজান

জনপ্রিয় অনলাইন
  • আপডেট সময় : ০৯:৫২:৪৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ এপ্রিল ২০২১ ৮৯৭ বার পড়া হয়েছে

দীর্ঘ এগারো মাস পর আমাদের করিডোরে কড়া নাড়ছে ‘শাহরু রামাদান’ তথা রমজান মাস। এটি আত্মশুদ্ধির মাস। এটি আত্মসংযমের মাস। রমজান মানে প্রজ্বলন, দহন বা পোড়ানো। পবিত্র রমজান মাসে সিয়াম সাধনের মাধ্যমে আমাদের মধ্যকার পারস্পরিক হিংসা, নিন্দা ও অশ্লীলতাকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তাই এ মাসকে রমজান বলা হয়। রোজা বা সাওমের আভিধানিক অর্থ হলো, বিরত থাকা। শরিয়তের পরিভাষায় ‘সুবহে সাদিক হতে সুর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সম্ভোগ থেকে বিরত থাকাকে সাওম তথা রোজা বলে’।

হজরত আদম আলাইহিসসালাম থেকে নিয়ে হজরত ঈসা আলাইহিসসালাম পর্যন্ত সকল নবী-রাসুলদের ওপর রোজা ফরজ ছিল। হজরত আদম (আ.) প্রত্যেক মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা রাখতেন। হজরত মুসা (আ.) তো জিলকদ ও জিলহজ্ব মাসের দশদিন রোজা রাখার পর তাওরাত কিতাব পেয়েছিলেন। হজরত নুহ (আ.) প্রত্যেক মাসে তিনটি করে রোজা রাখতেন। হজরত ইয়াহইয়া (আ.) এবং হজরত ঈসা আলাইহিসসালামও রোজা রেখেছেন। কিন্তু সে সময়ের রোজা আর এখনকার রোজার মধ্যে পার্থক্য আছে। তখনকার রোজার সময়সীমা, সংখ্যা, কখন তা রাখা হবে নির্ধারিত ছিল না এবং ধারাবাহিকভাবে একমাস রোজা রাখার প্রচলন ছিল না। পরবর্তীতে আমাদের প্রিয়নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় হিজরিতে পরিপূর্ণ একমাস রোজা রাখার বিধান নাজিল হয়। আল্লাহতায়ালা কোরআনুল কারীমে ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে; যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত-১৮৩)

রমজানে সিয়াম পালনের তাগিদ দিয়ে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘রমজান মাস, যাতে কোরআন নাজিল করা হয়েছে মানুষের হিদায়াতের জন্য এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে এই মাস পায় সে যেন রোজা পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তাহলে অন্যান্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান এবং কঠিন করতে চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ করো এবং তিনি তোমাদের যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্যে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত-১৮৫) হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-১৯০১)

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘রমজান মাসে আমার উম্মতের জন্য পাঁচটি বস্তু দান করা হয়েছে। যা আগের উম্মতদের দেওয়া হয়নি। ১. রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহতায়ালার কাছে মিেকর সুগন্ধির চেয়েও পছন্দনীয়। ২. ইফতার পর্যন্ত ফেরেশতাগণ তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ৩. আল্লাহতায়ালা প্রতিদিন জান্নাতকে রোজাদারদের জন্য সজ্জিত করেন এবং বলেন অচিরেই আমার সৎ বান্দাগণ ক্লেশ-যাতনা দূরে নিক্ষেপ করে আমার দিকে ফিরে আসবে। ৪. রমজানে শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখা হয়। যাতে তারা এসব পাপ কাজ করাতে না পারে যা অন্য মাসে করানো সম্ভব। ৫. রমজানে রোজাদারকে শেষ রাত্রে মাফ করে দেওয়া হয়।’ (মুসনাদ আহমাদ ইবনে হাম্বল, হাদিস নং-৭৯০৪) রোজার গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আস-সাওমু জুন্নাতুন’ অর্থাৎ, রোজা ঢালস্বরূপ। (সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-১৬৩৯) রোজাকে ঢাল বলার কারণ হচ্ছে, যুদ্ধে ঢাল যেমন তলোয়ার, তীর ও বল্লম থেকে যোদ্ধাকে হেফাজত করে; তেমনি রোজাও রোজাদারকে গুনাহের কাজ এবং জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করে।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আদম সন্তানের প্রতিটি ভালো আমল দশ থেকে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। মহান আল্লাহ বলেন, তবে রোজা ব্যতীত। কেননা তা আমার জন্য, আমি নিজ হাতেই এর প্রতিদান দেবো। সে তো তার প্রবৃত্তি ও পানাহার আমার জন্যই বর্জন করেছে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-২৭০৭) রোজাদারগণকে আল্লাহতায়ালা বিশাল সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে, হজরত সাহ্ল (রা.) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘জান্নাতে এমন একটি দরজা আছে যার নাম হলো রাইয়ান। কিয়ামাতের দিন এ দরজা দিয়ে কেবল রোজাদার ব্যক্তিগণই প্রবেশ করতে পারবে, অন্যরা কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। বলা হবে, রোজাদারগণ কোথায়? তারা ছাড়া কেউ এতে প্রবেশ করতে পারবে না। অতঃপর যখন রোজাদারগণ সেখানে প্রবেশ করবে, তখন তার দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। যাতে কেউ এতে প্রবেশ করতে না পারে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-১৮৯৬) মানুষ যখন রোজা রাখে, সারাদিন উপবাস থাকার কারণে মানুষের মুখে দুর্গন্ধ হয়। এ দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে খুবই পছন্দনীয়। এ দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মিেকর সুগন্ধির চেয়েও খুশবো। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘সে সত্তার শপথ! যার হাতে আমার জীবন। রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর নিকট মিেকর সুগন্ধির চেয়েও বেশি সুগন্ধিযুক্ত।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-১৯০৪)

রোজা আমাদের জন্য কতইনা সৌভাগ্যের। এ রোজা কিয়ামতের দিন আমাদের জন্য সুপারিশ করবে। হাদিসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘রোজা ও কোরআন বান্দার জন্য কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে রব! আমি তাকে পানীয় ও যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত রেখেছি। অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। আল-কোরআন বলবে, আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছি (সে আমাকে তিলাওয়াত করেছে)। অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। নবীজি বলেন, অতঃপর তাদের উভয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’ (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস নং-৬৬২৬)

রমজান পাওয়া সত্ত্বেও এ মাসে যদি আমরা আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফ করাতে না পারি তাহলে আমাদের চেয়ে দুর্ভাগা আর কে হতে পারে? হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, ‘ধ্বংস হোক ওই ব্যক্তি, যে রমজান মাস পেলো; কিন্তু তার গুনাহ মাফ করাতে পারলো না।’ (সুনান আল-কুবরা, হাদিস নং-৮৫০৪) রোজাদারদের জন্যে দুটি আনন্দ রয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘রোজাদারদের জন্য আনন্দের সময় হলো দুটি। ১. যখন সে ইফতার করে তখন সে ইফতারের আনন্দ পায়। ২. যখন সে তার প্রতিপালকের সাথে মিলিত হবে তখন তার রোজার কারণে আনন্দিত হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং- ১৯০৪) রোজা রেখে মিথ্যা বলা ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে না পারলে এ রোজা হবে অনর্থক। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও মিথ্যা আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং- ১৯০৩)

মাহে রমজানের উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া অর্জন করা। এ রমজান মাসের রোজা পালনের মাধ্যমে বান্দার মনে ভয় সৃষ্টি হয়। আল্লাহর কাছে মান মর্যাদা নির্ধারণের একমাত্র উপায় তাকওয়া। এই তাকওয়াই মানুষের মনে সৎ গুণাবলি সৃষ্টি করে। সুতরাং যাবতীয় অন্যায় কাজ থেকে বিরত থেকে ভালো কাজ করতে পারলেই আমাদের রোজা পালন সার্থক হবে। এই রমজান মাস থেকে আমাদের তাকওয়া শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। মাহে রমজানের রোজা মানুষের স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণ সংশোধনপূর্বক প্রকাশ্যভাবে সুন্দর করে দেয় এবং মানুষের পার্থিব লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, পরচর্চা, পরনিন্দা, মিথ্যাচার ও প্রতারণা প্রভৃতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখে আত্মসংযম শিক্ষা দেয়। রমজান মাসে ঈমানদার ব্যক্তির অন্তরে বেশি করে আল্লাহভীতি সৃষ্টি হয়। ফলে মুমিন বান্দাগণ আল্লাহ্র দরবারে বেশি বেশি মাগফিরাত কামনা করেন এবং সকল প্রকার খারাপ কাজ পরিত্যাগ করেন। আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ইবাদত-বন্দেগি, কুরআন তিলাওয়াত, জিক্র-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া ও ইস্তিগফার করেন। বস্তুত মাহে রমজানে একজন রোজাদার সারা বছরের পুণ্যের ঘাটতি পূরণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। ফলে নিজেকে সুশোভিত করে আত্মশুদ্ধি লাভ করেন।

আসুন, আমরা মাহে রমজানের রোজা যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করি। মহান আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আর এ রমজান মাসে আল্লাহতায়ালার কাছে বেশি বেশি করে ফরিয়াদ করি, মহান আল্লাহ যেনো প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের এ মহামারী থেকে আমাদের বাংলাদেশ এবং সারা বিশ্বের মানুষকে হেফাজতে রাখেন। সমপ্রতি দেশে যে ইসলাম বিদ্বেষীদের সরব হয়েছে, আল্লাহতায়ালা দেশের সকল মুসলমানকে তা থেকে পরিপূর্ণ আশ্রয় দান করুন। আমিন।

আমিনুর রহমান হাসান

আলেম, প্রাবন্ধিক

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

খোশ আমদেদ মাহে রমজান

আপডেট সময় : ০৯:৫২:৪৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ এপ্রিল ২০২১

দীর্ঘ এগারো মাস পর আমাদের করিডোরে কড়া নাড়ছে ‘শাহরু রামাদান’ তথা রমজান মাস। এটি আত্মশুদ্ধির মাস। এটি আত্মসংযমের মাস। রমজান মানে প্রজ্বলন, দহন বা পোড়ানো। পবিত্র রমজান মাসে সিয়াম সাধনের মাধ্যমে আমাদের মধ্যকার পারস্পরিক হিংসা, নিন্দা ও অশ্লীলতাকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তাই এ মাসকে রমজান বলা হয়। রোজা বা সাওমের আভিধানিক অর্থ হলো, বিরত থাকা। শরিয়তের পরিভাষায় ‘সুবহে সাদিক হতে সুর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সম্ভোগ থেকে বিরত থাকাকে সাওম তথা রোজা বলে’।

হজরত আদম আলাইহিসসালাম থেকে নিয়ে হজরত ঈসা আলাইহিসসালাম পর্যন্ত সকল নবী-রাসুলদের ওপর রোজা ফরজ ছিল। হজরত আদম (আ.) প্রত্যেক মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা রাখতেন। হজরত মুসা (আ.) তো জিলকদ ও জিলহজ্ব মাসের দশদিন রোজা রাখার পর তাওরাত কিতাব পেয়েছিলেন। হজরত নুহ (আ.) প্রত্যেক মাসে তিনটি করে রোজা রাখতেন। হজরত ইয়াহইয়া (আ.) এবং হজরত ঈসা আলাইহিসসালামও রোজা রেখেছেন। কিন্তু সে সময়ের রোজা আর এখনকার রোজার মধ্যে পার্থক্য আছে। তখনকার রোজার সময়সীমা, সংখ্যা, কখন তা রাখা হবে নির্ধারিত ছিল না এবং ধারাবাহিকভাবে একমাস রোজা রাখার প্রচলন ছিল না। পরবর্তীতে আমাদের প্রিয়নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় হিজরিতে পরিপূর্ণ একমাস রোজা রাখার বিধান নাজিল হয়। আল্লাহতায়ালা কোরআনুল কারীমে ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে; যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত-১৮৩)

রমজানে সিয়াম পালনের তাগিদ দিয়ে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘রমজান মাস, যাতে কোরআন নাজিল করা হয়েছে মানুষের হিদায়াতের জন্য এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে এই মাস পায় সে যেন রোজা পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তাহলে অন্যান্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান এবং কঠিন করতে চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ করো এবং তিনি তোমাদের যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্যে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত-১৮৫) হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-১৯০১)

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘রমজান মাসে আমার উম্মতের জন্য পাঁচটি বস্তু দান করা হয়েছে। যা আগের উম্মতদের দেওয়া হয়নি। ১. রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহতায়ালার কাছে মিেকর সুগন্ধির চেয়েও পছন্দনীয়। ২. ইফতার পর্যন্ত ফেরেশতাগণ তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ৩. আল্লাহতায়ালা প্রতিদিন জান্নাতকে রোজাদারদের জন্য সজ্জিত করেন এবং বলেন অচিরেই আমার সৎ বান্দাগণ ক্লেশ-যাতনা দূরে নিক্ষেপ করে আমার দিকে ফিরে আসবে। ৪. রমজানে শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখা হয়। যাতে তারা এসব পাপ কাজ করাতে না পারে যা অন্য মাসে করানো সম্ভব। ৫. রমজানে রোজাদারকে শেষ রাত্রে মাফ করে দেওয়া হয়।’ (মুসনাদ আহমাদ ইবনে হাম্বল, হাদিস নং-৭৯০৪) রোজার গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আস-সাওমু জুন্নাতুন’ অর্থাৎ, রোজা ঢালস্বরূপ। (সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-১৬৩৯) রোজাকে ঢাল বলার কারণ হচ্ছে, যুদ্ধে ঢাল যেমন তলোয়ার, তীর ও বল্লম থেকে যোদ্ধাকে হেফাজত করে; তেমনি রোজাও রোজাদারকে গুনাহের কাজ এবং জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করে।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আদম সন্তানের প্রতিটি ভালো আমল দশ থেকে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। মহান আল্লাহ বলেন, তবে রোজা ব্যতীত। কেননা তা আমার জন্য, আমি নিজ হাতেই এর প্রতিদান দেবো। সে তো তার প্রবৃত্তি ও পানাহার আমার জন্যই বর্জন করেছে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-২৭০৭) রোজাদারগণকে আল্লাহতায়ালা বিশাল সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে, হজরত সাহ্ল (রা.) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘জান্নাতে এমন একটি দরজা আছে যার নাম হলো রাইয়ান। কিয়ামাতের দিন এ দরজা দিয়ে কেবল রোজাদার ব্যক্তিগণই প্রবেশ করতে পারবে, অন্যরা কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। বলা হবে, রোজাদারগণ কোথায়? তারা ছাড়া কেউ এতে প্রবেশ করতে পারবে না। অতঃপর যখন রোজাদারগণ সেখানে প্রবেশ করবে, তখন তার দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। যাতে কেউ এতে প্রবেশ করতে না পারে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-১৮৯৬) মানুষ যখন রোজা রাখে, সারাদিন উপবাস থাকার কারণে মানুষের মুখে দুর্গন্ধ হয়। এ দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে খুবই পছন্দনীয়। এ দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মিেকর সুগন্ধির চেয়েও খুশবো। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘সে সত্তার শপথ! যার হাতে আমার জীবন। রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর নিকট মিেকর সুগন্ধির চেয়েও বেশি সুগন্ধিযুক্ত।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-১৯০৪)

রোজা আমাদের জন্য কতইনা সৌভাগ্যের। এ রোজা কিয়ামতের দিন আমাদের জন্য সুপারিশ করবে। হাদিসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘রোজা ও কোরআন বান্দার জন্য কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে রব! আমি তাকে পানীয় ও যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত রেখেছি। অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। আল-কোরআন বলবে, আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছি (সে আমাকে তিলাওয়াত করেছে)। অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। নবীজি বলেন, অতঃপর তাদের উভয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’ (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস নং-৬৬২৬)

রমজান পাওয়া সত্ত্বেও এ মাসে যদি আমরা আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফ করাতে না পারি তাহলে আমাদের চেয়ে দুর্ভাগা আর কে হতে পারে? হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, ‘ধ্বংস হোক ওই ব্যক্তি, যে রমজান মাস পেলো; কিন্তু তার গুনাহ মাফ করাতে পারলো না।’ (সুনান আল-কুবরা, হাদিস নং-৮৫০৪) রোজাদারদের জন্যে দুটি আনন্দ রয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘রোজাদারদের জন্য আনন্দের সময় হলো দুটি। ১. যখন সে ইফতার করে তখন সে ইফতারের আনন্দ পায়। ২. যখন সে তার প্রতিপালকের সাথে মিলিত হবে তখন তার রোজার কারণে আনন্দিত হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং- ১৯০৪) রোজা রেখে মিথ্যা বলা ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে না পারলে এ রোজা হবে অনর্থক। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও মিথ্যা আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং- ১৯০৩)

মাহে রমজানের উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া অর্জন করা। এ রমজান মাসের রোজা পালনের মাধ্যমে বান্দার মনে ভয় সৃষ্টি হয়। আল্লাহর কাছে মান মর্যাদা নির্ধারণের একমাত্র উপায় তাকওয়া। এই তাকওয়াই মানুষের মনে সৎ গুণাবলি সৃষ্টি করে। সুতরাং যাবতীয় অন্যায় কাজ থেকে বিরত থেকে ভালো কাজ করতে পারলেই আমাদের রোজা পালন সার্থক হবে। এই রমজান মাস থেকে আমাদের তাকওয়া শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। মাহে রমজানের রোজা মানুষের স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণ সংশোধনপূর্বক প্রকাশ্যভাবে সুন্দর করে দেয় এবং মানুষের পার্থিব লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, পরচর্চা, পরনিন্দা, মিথ্যাচার ও প্রতারণা প্রভৃতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখে আত্মসংযম শিক্ষা দেয়। রমজান মাসে ঈমানদার ব্যক্তির অন্তরে বেশি করে আল্লাহভীতি সৃষ্টি হয়। ফলে মুমিন বান্দাগণ আল্লাহ্র দরবারে বেশি বেশি মাগফিরাত কামনা করেন এবং সকল প্রকার খারাপ কাজ পরিত্যাগ করেন। আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ইবাদত-বন্দেগি, কুরআন তিলাওয়াত, জিক্র-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া ও ইস্তিগফার করেন। বস্তুত মাহে রমজানে একজন রোজাদার সারা বছরের পুণ্যের ঘাটতি পূরণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। ফলে নিজেকে সুশোভিত করে আত্মশুদ্ধি লাভ করেন।

আসুন, আমরা মাহে রমজানের রোজা যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করি। মহান আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আর এ রমজান মাসে আল্লাহতায়ালার কাছে বেশি বেশি করে ফরিয়াদ করি, মহান আল্লাহ যেনো প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের এ মহামারী থেকে আমাদের বাংলাদেশ এবং সারা বিশ্বের মানুষকে হেফাজতে রাখেন। সমপ্রতি দেশে যে ইসলাম বিদ্বেষীদের সরব হয়েছে, আল্লাহতায়ালা দেশের সকল মুসলমানকে তা থেকে পরিপূর্ণ আশ্রয় দান করুন। আমিন।

আমিনুর রহমান হাসান

আলেম, প্রাবন্ধিক