লকডাউনে বিপাকে কর্মজীবীরা
- আপডেট সময় : ০৯:৫২:০৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ৫ এপ্রিল ২০২১ ৯৬১ বার পড়া হয়েছে
করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীবাসীর দুর্ভোগের শুরু হয় ৩১ মার্চ থেকে। কারণ সেদিন থেকেই গণপরিবহনে অর্ধেক পরিবহন যাত্রী বহনের নির্দেশনা দেয় সরকার। এরপর গত শনিবার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের লকডাউন সম্পর্কিত ঘোষণায় অনেকেই ঢাকা ছাড়তে শুরু করেন। এ সময় রাজধানীর বিভিন্ন রুটের অনেক পরিবহন বেশি লাভের আশায় ঢাকার বাইরের ট্রিপ দিতে শুরু করায় নগরীতে পরিবহন সংকট দেখা দেয়। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় কর্মজীবী মানুষকে। রোববার রাতের চিত্র ছিল আরো ভয়ংকর। প্রচণ্ড ঝড় আর বৃষ্টির মধ্যে শত শত মানুষকে গণপরিবহনের অভাবে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছতে হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়তে হয় কর্মজীবী নারীদের।
পরিবহন সংকটের কারণে একই চিত্রের দেখা মেলে গতকাল লকডাউনের প্রথম দিনও। বিভিন্ন অফিস ও কলকারখানা খোলা থাকায় পায়ে হেঁটেই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয় কর্মজীবীদের। রাজধানীর বাড্ডার সাঁতারকুল এলাকার এক কর্মজীবী নারী রিজিয়া বেগম জানান, রামপুরার একটি পোশাক কারখানায় তিনি চাকরি করেন। গাড়ি না পেয়ে হেঁটেই তিনি অফিসের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। তার মতো আরো অনেক পোশাকশ্রমিককে দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটেই অফিস করতে হচ্ছে। অনেককে চলতি পথে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
এ প্রসঙ্গে গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম সবুজ বাংলাদেশের খবরকে জানান, ঢাকা এবং আশুলিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় গণপরিবহন না থাকায় কারখানায় যেতে ভোগান্তির বিষয়ে ফোন পাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা সরকারকে আগেই বলেছি, শ্রমিকদের কারখানায় যেতে পরিবহনের ব্যবস্থা করার জন্য। মালিকরা কেউই তার বাস্তবায়ন করেনি এবং সরকারও এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সরকার শুধু লকডাউন ঘোষণা করেই খালাস।’
তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, পরিবহনের কারণে শ্রমিকরা যদি কারখানায় যেতে না পারে আর এজন্য কোনো শ্রমিককে ছাঁটাই কিংবা বেতন কর্তন করা হয় তাহলে পরিস্থিতি খারাপ হবে। কারণ আমরা শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় সচেতন।’
কিছু কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান কর্মীদের জন্য নিজস্ব ব্যবস্থায় পরিবহন সংকট দূর করলেও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই এমন ব্যবস্থা না নেওয়ায় চাকরি বাঁচাতে পদব্রজেই অফিস করতে হচ্ছে। নদ্দা এলাকার বাসিন্দা রিমন হোসেন জানান, তিনি মহাখালীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। গণপরিবহন না থাকা এবং তার অফিস থেকে গাড়ির ব্যবস্থা না করায় পায়ে হেঁটেই অফিসে যেতে হচ্ছে তাকে। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা সাধারণ মানুষ ফাঁদে পড়ে গেছি। একদিকে চাকরি বাঁচানো, অন্যদিকে গণপরিবহনের অভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। আমরা করোনা-ফরোনা বুঝি না। পেটের দায়ে জীবন গেলেও আমাদের অফিস করতে হবে, এটাই বাস্তবতা।’
তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘সরকারের উচিত ছিল হয় অফিস-আদালত বন্ধ করে দেওয়া, নয়তো গণপরিবহনগুলোতে আগের মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনুমতি দেওয়া।’ কর্মজীবী মানুষের ভোগান্তির এমন অসংখ্য চিত্র এখন নগরজুড়ে।
এ তো গেল গণপরিবহনের অভাবে মানুষের দুর্ভোগের কথা। লকডাউনের কারণে অর্থনৈতিকভাবে সংকটে পড়ার শঙ্কাও তীব্র হচ্ছে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষগুলোর মাঝে। বেকার হয়ে পড়া পরিবহন শ্রমিক, খেটে খাওয়া দিনমজুর, বিভিন্ন শপিংমলের কর্মচারীসহ অনেকেই অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন গুনতে শুরু করেছেন। নুন আনতে পানতা ফুরোনো মানুষগুলোর জন্য লকডাউন যেন এক অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। এ কারণে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় লকডাউনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে খেটে খাওয়া মানুষদের। গেল বছর লকডাউনের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে না উঠতেই আবারো লকডাউনের কবলে পড়ে বেকার হয়ে পড়া মানুষগুলো দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। উত্তর বাড্ডার জসিমদ্দিন জানান, তিনি ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করেন। আসন্ন ঈদকে কেন্দ্র করে ঋণ করে বেশ কিছু পোশাক কিনেছেন বিক্রির জন্য। কিন্তু রমজানের আগ মুহূর্তে লকডাউন দেওয়ায় অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গিয়েছেন। জসিম বলেন, ‘লকডাউন যদি এক সপ্তাহের জন্য হয় তাহলে হয়তো তেমন সমস্যা হবে না। কিন্তু গত বছরের মতো এবারো দীর্ঘ হয় লকডাউন তাহলে মাঠে মারা পড়ব।’
সিলেটের ছেলে রিয়াদের বসবাস রাজধানীর রামপুরায়। ১০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন শপিংমলে। সাময়িক লকডাউনে বেকার হয়ে পড়েছেন। লকডাউন উঠে গেলে চাকরি ফিরে পাবেন ঠিকই; কিন্তু এই কদিনের বেতন পাবেন না তিনি। তাতেও তার দুঃখ নেই। দুশ্চিন্তা হলো, যদি লকডাউন আরো দীর্ঘ হয় তাহলে বিপাকে পড়ে যাবেন তিনি। রিয়াদ, জসিমদের মতো নিম্ন আয়ের এমন অসংখ্য মানুষ লকডাউনের কারণে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মাঝে পড়ে বিপাকে পড়েছেন। যাত্রীবাহী পরিবহন বন্ধ হওয়ায় বাস, ট্রাক, সিএনজি, লঞ্চের চালক, রং মিস্ত্রি, ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, বিশেষ করে চা, পান বিক্রেতা, হকার, কাঠমিস্ত্রিসহ নিম্নবিত্ত মানুষের দুর্দশার শেষ নেই।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, সাত দিন পরে সংক্রমণ বিবেচনা করে যদি লকডাউন খুলে দেওয়া হয় তাহলে ঠিক আছে। নয়তো তাদের জীবন-জীবিকা অচল হয়ে পড়বে। গত বছর লকডাউনের কারণে অনেকে পেশা পরিবর্তন করেছেন। বড় প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করেছে, বেতন কমিয়েছে। বন্ধ হয়েছে ইনক্রিমেন্ট, প্রমোশন। অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তাই অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সরকার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিতে পারে। অসহায়, ছিন্নমূল, নিম্নবিত্ত, হতদরিদ্র মানুষদের জন্য সহায়তামূলক কর্মসূচি নিতে পারে। খেটে খাওয়া এই মানুষকে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সহায়তা করতে পারে সরকার।
এদিকে পরিসংখ্যান বলছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। ২০১৮ সালে এটি ছিল ২১.৬ শতাংশ। শহরাঞ্চলে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ২০১৮ সালে ছিল ১৬.৩ শতাংশ, যা করোনাকালে ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫.৪ শতাংশে। ২০১৮ সালে গ্রামাঞ্চলে চরম দারিদ্র্যের হার ছিল ১১.২ শতাংশ। মহামারীর সময়ে ২০২০ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৩৩.২ শতাংশ। ২০১৮ সালে শহরাঞ্চলে চরম দারিদ্র্যের হার ছিল ৬.১ শতাংশ, যা ২০২০ সালে বেড়ে হয়েছে ১৯ শতাংশ। অন্যদিকে জাতীয় পর্যায়ে গড় মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় বেড়েছে মধ্যম দরিদ্রদের ৯৭ শতাংশ এবং অতিদরিদ্রদের ক্ষেত্রে ১০৪ শতাংশ। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে দেখা গেছে, বর্তমানে পরিবারভিত্তিক মাসিক আয় প্রায় ৪ হাজার টাকা কমে সাড়ে ১৫ হাজার টাকা হয়েছে। বেকারত্ব দশগুণ বেড়েছে।
সুত্র : বাংলাদেশের খবর ।