প্রবাসীরা লেবাননে অর্থনৈতিকভাবে চরম বিপদে
- আপডেট সময় : ০৬:৪১:৪৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২১ মার্চ ২০২১ ১০২৩ বার পড়া হয়েছে
মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে লেবানিজ পাউন্ডে পাওয়া বেতনের অর্থ মার্কিন ডলার করতে গিয়ে আগের তুলনায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ ডলার পেয়েছেন বৈরুতে কর্মরত রুবেল মিয়া।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে তার স্ত্রী, বৃদ্ধ বাবা-মা ও ভাই-বোনরা সংসার চালানোর খরচের জন্য অপেক্ষায় থাকেন রুবেলের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর।
২০১৫ সাল থেকে লেবাননে কাজ করছেন রুবেল। গত এক বছরে মাত্র দুবার দেশে টাকা পাঠাতে পেরেছেন তিনি। নানাভাবে বিপর্যস্ত দেশটিতে তারল্য সংকটের কারণে মার্কিন ডলার দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। ফলে তার মতোই চরম ভোগান্তিতে আছেন দেশটিতে কর্মরত প্রবাসীরা।
২৯ বছর বয়সী পরিচ্ছন্নতা-কর্মী রুবেল বলেন, ‘আমি মাসে প্রায় ছয় লাখ লেবানিজ পাউন্ড আয় করি। সেটা থেকে স্বাভাবিক সময়ে পেতাম ৪০০ মার্কিন ডলার। কিন্তু এখন এই সংকটের কারণে ডলার যা পাচ্ছি তা না পাওয়ার মতোই।’
আগে লেবানিজ পাউন্ডের পরিবর্তে ব্যাংক থেকে একটি সুনির্দিষ্ট বিনিময় মূল্য দিয়ে মার্কিন ডলার সংগ্রহ করা যেত। কিন্তু বর্তমানে ব্যাংকগুলো ডলার উত্তোলনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ফলে খোলা বাজারে মার্কিন মুদ্রার দাম বেড়ে যাচ্ছে।
মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে রুবেল লেবানিজ মুদ্রায় আগের সমান বেতন পেলেও ডলারে পাচ্ছেন পাঁচ ভাগের এক ভাগ।
দেশে ফিরতে বাংলাদেশি দূতাবাসের সাহায্য চেয়ে হতাশ এই যুবক বলেন, ‘দুই বছর আগে আমার মাসিক লেবানিজ পাউন্ডে পাওয়া বেতন টাকায় রূপান্তর করলে ৩২ হাজার টাকা পেতাম। কিন্তু এখন পাই মাত্র ছয় হাজার টাকা। এখানে টিকে থাকাই দায় হয়ে যাচ্ছে।’
রুবেলের মতো আরও অন্তত এক লাখ ৩০ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক মন্দায় তীব্র আর্থিক সমস্যায় পড়েছেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের শেষের দিকে প্রবাসী লেবানিজদের কাছ থেকে আসা রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় দেশটিতে মার্কিন ডলারের ঘাটতি বেড়েছে এবং সেখানে অর্থনৈতিক মন্দার এটি একটি অন্যতম কারণ।
এসব কারণে লেবাননের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে এবং ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীরা ডলার পাচ্ছেন না। পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে ব্যাংকগুলো লেবানিজ পাউন্ডের বিনিময়ে মার্কিন ডলার উত্তোলন ও স্থানান্তরের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন বলে সংবাদমাধ্যম থেকে জানা গেছে।
কয়েক দশক ধরে লেবাননে মুদ্রার পরিবর্তনশীল বিনিময় মূল্যের পরিবর্তে পূর্বনির্ধারিত বিনিময় মূল্য ব্যবহার করা হয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, লেবানিজ সরকার এক মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য হিসেবে এক হাজার ৫০৭ লেবানিজ পাউন্ড (বা লিরা) নির্ধারণ করেছিল। প্রয়োজনে সরকার বাড়তি মূল্যকে ভর্তুকি হিসেবে প্রদান করত। এই ভর্তুকি জ্বালানি তেল থেকে শুরু করে ময়দা পর্যন্ত সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল।
এক্সচেঞ্জ হাউস ও ব্যাংকগুলোর জন্য সরকার এখন মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য হিসেবে তিন হাজার ৯০০ লেবানিজ পাউন্ড নির্ধারণ করে দিয়েছে। তবে জ্বালানি তেল ক্রয়ের ক্ষেত্রে আগের এক হাজার ৫০৭ মূল্যমানটি ব্যবহার করা হচ্ছে।
বৈরুতভিত্তিক দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৮ ফেব্রুয়ারি কালোবাজারে মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮ হাজার ৯০০ লেবানিজ পাউন্ড।
এএফপির বরাত দিয়ে টিআরটি ওয়ার্ল্ড জানায়, গত ২ মার্চ এই মূল্য দাঁড়ায় ১০ হাজার লেবানিজ পাউন্ডে।
এই গভীর সংকটে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার ৯৯০ জন অভিবাসী শ্রমিক দেশে ফিরে আসতে চেয়ে বাংলাদেশ মিশনে আবেদন করেছেন। আরও কয়েক হাজার শ্রমিক নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অপেক্ষায়।
বৈরুতে বাংলাদেশ মিশন থেকে জানানো হয়, ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলাদেশ অভিমুখী বিশেষ ফ্লাইট চালু হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত প্রায় চার হাজার ৬০০ নিবন্ধিত কর্মী দেশে ফিরেছেন।
শ্রমিকদের কাছে নেই ভাড়ার টাকা
৫০ বছর বয়সী শহীদ উল্লাহ বলেছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে কালোবাজারে ৪০০ ডলার পেতে দিতে হচ্ছে তিন কোটি লেবানিজ পাউন্ড। এটা অনেক শ্রমিকের এক বছরের আয়ের চেয়েও বেশি।
গত ৫ মার্চ দেশে ফেরার অপেক্ষায় থাকা শহীদ সংবাদকর্মীর সঙ্গে কথা বলেন।
তিনি জানান, লেবাননের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেই এখন পর্যন্ত নিবন্ধিতরা ছাড়াও প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু তাদের অনেকেই উড়োজাহাজের টিকিটের দাম ৪০০ ডলার জোগাড় করতে পারেননি। ফলে অনেকে ফেরার জন্য তাদের নাম নিবন্ধন করতে পারেননি।
লেবাননে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন শহীদ। বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তার অনুরোধ, যারা ভাড়া দিতে পারছেন না এবং ইতোমধ্যে দেশে ফিরবার জন্য অর্থ দিয়েছেন তাদের যেন কিছু অর্থ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। গত ১৩ মার্চ দেশে ফিরেছেন শহীদ।
গত বছরের ডিসেম্বরে দেশে ফিরতে আগ্রহী অনিবন্ধিত শ্রমিকদের নিবন্ধনের সময় উড়োজাহাজ ভাড়া বাবদ ৪০০ ডলার (১৮ বছরের বেশি বয়সীদের) এবং এক লাখ ৪০ হাজার লেবানিজ পাউন্ড জরিমানা বা ফি হিসেবে জমা দিতে বলে বৈরুতে বাংলাদেশ দূতাবাস।
ফেসবুক পোস্টে মিশনের একটি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, উড়োজাহাজের টিকিটের দাম মার্কিন ডলারে পরিশোধ করতে হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বৈরুতে বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রমসচিব আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ডলারে টিকিটের দাম পরিশোধের শর্তটি এয়ারলাইন্স থেকে দেওয়া হয়েছে।
দূতাবাসের হেড অব চ্যান্সরিরও দায়িত্বে থাকা মামুন মুঠোফোনে সংবাদকর্মীকে বলেন, তারা নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালিয়ে যাবেন। আগামী মাসে আরও এক হাজার ৫০০ অনিবন্ধিত শ্রমিকের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে।
লেবাননে বর্তমানে বসবাসরত প্রায় এক লাখ ২০ হাজার থেকে এক লাখ ৩০ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিকের মধ্যে ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজারের অনিবন্ধিত বলে ধারণা এই কর্মকর্তার।
দূতাবাসের আরেক কর্মকর্তা জানান, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে লেবাননে কমবেশি সব বাংলাদেশি শ্রমিকই সঙ্কটের মুখোমুখি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই কর্মকর্তা জানান, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে লেবাননে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। তবে তারচেয়েও বড় সমস্যা হল দেশটির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সঙ্কট।
তিনি বলেন, অনেক শ্রমিকের মাসিক বেতন বাড়লেও সেটি যথেষ্ট না।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, লেবাননের অর্থনৈতিক পতন, মার্কিন ডলারের সংকট এবং সুশাসনের অভাব গত দেড় বছর ধরে বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, গত বছরের আগস্টে বৈরুতে বিস্ফোরণের ঘটনার পর পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়েছে।
শরিফুল হাসান বলেন, ‘অনেক (অভিবাসী শ্রমিক) চাকরি হারানোর দ্বারপ্রান্তে। তারা তাদের দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে পারছেন না। ফলে দেশে ফিরে আসতে চান।’
শরিফুল আরও বলেন, লেবাননের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার অনিশ্চিত। বাংলাদেশের উচিৎ সতর্ক হওয়া এবং দেশটিতে নতুন শ্রমিক পাঠানোর বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা।
শ্রমিকদের আর্থিক সমস্যা সমাধানে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে উড়োজাহাজ ভাড়া ও অন্যান্য বকেয়া পাওনা আদায়ে মন্ত্রণালয় বা দূতাবাসের ভূমিকা পালন করা উচিৎ বলে মনে করেন তিনি।
দেউলিয়া হওয়ায় যদি কোনো নিয়োগদাতা উড়োজাহাজ ভাড়া দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে বাংলাদেশ সরকারকে দেশে ফিরতে আগ্রহী শ্রমিকদের জন্য ফ্লাইটের ব্যবস্থা করতে হবে এবং ভাড়া দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে বলে যোগ করেন শরিফুল।
কমছে রেমিট্যান্স লেবাননের অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে গত কয়েক বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি থেকে রেমিট্যান্স আসা অনেকটাই কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-২০১৯ সালে লেবানন থেকে বাংলাদেশে প্রায় ১২ কোটি ৬৮ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল।
এক বছর পরে, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে লেবানন থেকে আসা রেমিট্যান্স কমে দাঁড়ায় আট কোটি ৬৯ লাখ ৯০ হাজারে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই প্রান্তিকে মাত্র তিন কোটি ৬৭ লাখ ১০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে।
সুত্র, দ্য ডেইলি স্টার ।